Rose Roseমেকুর (ধারাবাহিক গল্পঃ পর্ব--৪) Rose Rose

লিখেছেন লিখেছেন মামুন ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ০৬:৪৫:১৩ সন্ধ্যা



Roseপকেটে দশটি টাকাই শেষ সম্বল।

সামনে গোটা একটা দিন। তিন বেলা খেতে হবে। আচ্ছা একবেলা না হয় বাদ-ই দিলো। বাকি দুই বেলা? আমি দেখেছি পকেটে যখন টাকা থাকেনা, ক্ষিদেগুলো রাক্ষসের মতো শুধু খাই খাই করে।

রাক্ষসের কথা কেন মনে হল? দেখেছি কি কখনো?

নাহ! তবে?

এমনি-ই মাথায় চলে এলো।

বাহ! এমনি এমনি মাথায় চলে এলো! তবে সামনের ঐ ফার্স্টফুডের দোকানের কাঁচের নীচের খাবারগুলো এমনি এমনি আমার পেটে ঢুকে যেতে পারে না?

ঐ তো দু'জন বসে বসে সমুচা খাচ্ছে। একজন বোতল থেকে সস বের করছে। টকটকে লাল টমেটো সসের বোতলটিকে কাত করে ক্ষুদে প্লেটটিতে ঢালছে। অন্যজনের ডান হাতে সমুচা। সে ওটা বাম হাতে রেখে ডান হাতের একটা আংগুল দিয়ে একটুখানি সস তুলে জিহ্বায় নিয়ে চোখ বুঝে স্বাদ নিতে লাগলো। ব্যাটা সস মনে হয় কোনোদিন খায়নি। তার হাতের নখগুলো বেশ বড়... এবং ময়লায় কালো দেখাচ্ছে। অন্যজন দেখেও দেখলো না। নির্বিকারভাবে সসের বোতল খালি করায় ব্যস্ত। দোকানিও নির্লিপ্ত ভাবে চেয়ে আছে। তবে ফাইফরমাস খাটা ছোট ছেলেটা বিরক্তিভরা দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। মনে মনে হয়তো বলছে, ' খাবি তো ব্যাটারা মোটে দুইটা সমুচা । খালি করছিস পুরো সসের বোতল!'

ময়লা নখওয়ালা এবার সমুসায় মাখন মাখানোর মতো করে সস লাগিয়ে বড় এক কামড় বসায়। ওর মুখের অবস্থা দেখবার মত হল।শব্দ করে চাবানোর সাথে সাথে মুখের দু'পাশ থেকে ঝুরঝুর করে সমুচার অংশবিশেষ নিজের শরীরে পড়ছে।সেখান থেকে তুলে আবার মুখে পুরছে। ওদের থেকে সামান্য দূরত্বে দাঁড়িয়ে পকেটে দশটাকা নিয়ে আমি এসব দেখছি। আর ভাবছি, এইসব গিদার যারা ভদ্রভাবে খেতেও জানেনা- এদের পকেটেই অফুরন্ত টাকা! আরো একটু কাছে গিয়ে আমি ওদের সমুচা খাওয়া দেখতে থাকি। চোখ খাবারের দিকে... ইচ্ছে করে মুখের পাচকরস সহ দৃষ্টিকটু ভঙ্গীতে দু'বার ঢোক গিললাম...জিহ্বা বের করে নীচের ঠোঁট ভিজিয়ে লোভীর ভঙ্গী করি। আবার ঢোক গিলি। শুনেছি কেউ খাবার সময়ে অভুক্ত কারো নজর খাবারের দিকে পড়লে নাকি যে খায় তার পেট ব্যথা করে। আমি চাইছি এই গিদার দুটোর উপর আমার নিজের অভুক্ত নজর পড়ুক। ব্যাটাদের প্রচন্ড পেট ব্যাথা করুক। ব্যথায় ওরা মেঝেতে গড়াগড়ি দিক। অবশ্য দু'জনের হাতের নখের যা ছিরি (শ্রী)- পুরো ডাস্টবিনেও মনে হয় এমন ভয়ানক উপাদান নেই । আমার নজরের প্রয়োজন নেই। এমনিতেই পেটব্যথায় এদের গড়াগড়ি দেবার কথা।

এভাবে একজন অপরিচিত মানুষ ওদের খাওয়া দেখছে-তাও এতোটা অশোভন ভাবে। এবারে এক গিদার মুখের খাবারটুকু কোৎ করে গিলে আমাকে লক্ষ্য করে বলল, ' কিছু বলবেন ভাইয়া?' দোকানির চোখে আমাকে ঠিক কাস্টোমারের মতোও লাগছে না। মানে ক্যাম্পাসের এই দোকানগুলোতে যেরকম মানুষ আসে তাদের মতো আর কি। আবার ভিক্ষুকের মতোও লাগছে তাও বলতে পারবে না। একটা ইন ছাড়া লম্বা ফুলহাতা শার্ট, প্যান্টের সাথে ততোটা বেমানানও লাগছে না। তবে পায়ে একটা স্পঞ্জের স্যান্ডেলই জাত মেরে দিয়েছে আমার।নীল ফিতাওয়ালা স্যান্ডেল। সামনের অংশে অতিরিক্ত পানি লেগে লেগে শ্যাওলা ধরা কালো দাগ পড়েছে। তেলতেলে একটা ভাব স্পষ্ট বোঝা যায়। সাধারণত বাথরুমে অবহেলায় এ ধরণের স্পঞ্জগুলো মাসের পর মাস পড়ে থাকে। ফিতে ছেড়ার অপেক্ষায় প্রহর গোনে।

যাহোক দোকানি একটু বিব্রত হলেও ওর স্লাভিক চৌকো চেহারায় কোনো ভাব ফুটে ওঠে না। হয়তো ওঠে কিন্তু স্বভাবজাত নির্লিপ্ততার আড়ালে তা ঢাকা পড়ে যায়। আমাকে প্রশ্ন করা গিদারটির গোঁফ রয়েছে। সেখানেও সমুচার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ চুম্বকের সাথে লোহার গুড়ো যেভাবে আটকে থাকে, সেভাবে লেগে রয়েছে। কালো গোঁফে হলুদ খাদ্যকণা। হলুদ দেখাতেই আমার কাছে এক 'বিশেষ পদার্থের' কথা মনে হল। আমি মনে মনে এই প্রশ্নকারী গিদারের নাম দিলাম ' গুইয়্যা গুঁফো'। নবাবদের মতো করে নামকরণ হলে এর নাম হতো ' গুইয়্যা গুঁফো গিদার নাম্বার ওয়ান ফ্রি সসের বোতল ঝাকানেওয়ালা।'

আমি ওর প্রশ্নের উত্তরে বললাম, ' হ্যা, অবশ্যই। বলতেই তো এসেছি।' দুই গিদারসহ দোকানের চারজনই আমার দিকে তাকায়। তিনজনের চোখে আগ্রহ আর একজন নির্লিপ্ত।

আমি 'সস চাটা গিদার নাম্বার টু' এর রানের উপরে সমুচার চর্বিত একটা টুকরোর দিকে নির্দেশ করে বলি, ' খাবার অপচয় করা যাবে না। অপচয়কারীকে শয়তানের ভাই বলা হয়েছে। তাই ওটা এখুনি খেয়ে নিন।' গিদার নাম্বার টু এর চোখ বড় বড় হয়ে যায়। নিজের অজান্তেই সে সমুচার ঐ চর্বিত টুকরোটি নিয়ে মুখে পুরে দেয়। এবার আমি 'গুইয়্যা গুঁফোকে' বললাম, 'আপনার গোঁফেও লেগে রয়েছে। তবে গোঁফে লেগে থাকা খাবার খাওয়া হারাম হবে। পানি খেতেও সাবধানে খাবেন। এজন্যই গোঁফকে ছেটে ছোট রাখতে বলা হয়েছে।'

আমার কথায় দুই গিদার একটু ভড়কে যায়। ভীত কন্ঠে নাম্বার টু বলে, 'আপনি কে ভাই?' উত্তর না দিয়ে আমি একটু সামনের দিকে এগিয়ে যেয়েও আবার ফিরে আসি। বলি, ' আমি কে সেটা জানা এতোটা জরুরী নয়। তবে আমাকে পাঠানো হয়েছে ঐ গুলো দেখার জন্য।' দুই গিদারের হাতের নখের দিকে নির্দেশ করে এবার বললাম।

দোকানি এবং তার কর্মচারী এবার গিদারদের নখের দিকে তাকায়। গিদার দুজন নিজেরাও তাকায় এবং নিজেদের সৃষ্ট নোংরামি দেখে লজ্জা পায় এবং আরো একটু ভড়কে যায়। একবার নিজেদের নখের দিকে এবং পরক্ষনেই আমার মুখের দিকে তাকায়। আমি কিছু না বলে সামনের দিকে চলে যাই। চারজন মানুষকে সকালবেলাতেই বিভ্রান্ত করে দিতে পেরেছি! এই আনন্দ নিয়ে আমি রাস্তার ওপাশের যাত্রী ছাউনিটির দিকে এগিয়ে গেলাম। পেটে প্রচন্ড ক্ষুধা... পকেটে দশটি টাকা। সবে দশটা বাজে। আরো কয়েক বেলার খাবার কীভাবে ম্যানেজ হবে তার জন্য মনের ভিতরে দুশ্চিন্তা! হলে গিয়ে এভাবে বাকিতে খেতে আর ইচ্ছে করছিল না।

ছাউনিতে বসে বসে আমার থেকে অনেক ছোট দুই ছোকরা সিগ্রেটে গাঁজা ভরছিল। একজন সিগারেটের ভিতর থেকে 'সুকা' (তামাক) ফেলে দিচ্ছে। অন্যজন তার হাতের চেটোতে (তালু) গাঁজা রেখে নখ দিয়ে খুটে খুটে ছিড়ছে। এ ক্ষেত্রে নখ ব্লেডের কাজ করছে। আমাকে হঠাৎ ভিতরে ঢুকতে দেখে দুজনেই ফ্রিজ হয়ে গেলো। সিগারেটের 'সুকা' যে ফেলছিল সে ওটাকে স্বাভাবিক ভাবে ধরে রাখে। যেন এখুনি সিগারেট ধরাতে যাচ্ছিল। আর হাতের চেটোতে গাঁজা নিয়ে যে ছিড়ছিল সে অন্য হাতকে গাঁজা রাখা হাতের সাথে মিলিয়ে বসে রইলো। ওরা কথা বলা শুরু করে, ' আর কতক্ষণ অপেক্ষা করবো দোস্তো? একটা বাসও আসছে না।' অন্যজন বলল, ' বসে থাক, আসবে।' অথচ একের পর এক বাস আসছে আর যাচ্ছে।

আমি যেন ওদেরকে দেখেও দেখলাম না। পকেট থেকে মোবাইল বের করে একটা কাল্পনিক নাম্বারে ডায়াল করি। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করি ওপাশের অদৃশ্য ব্যক্তির ফোন রিসিভ করার জন্য। এরপর বললাম, ' হ্যা স্যার, আপনার ইনফর্মেশন ঠিকই ছিল। আমি যায়গামতোই এসেছি। হ্যা ফোর্স আশেপাশেই রয়েছে। ... কি বললেন? দুজন?...'

এবার সে ছেলে দুটির দিকে তাকালাম... একটু দেখে আবার কথা বলে যেতে থাকি, ' হ্যা হ্যা, অল্পবয়সী। ওরাই... আজকাল এরাই সিন্ডিকেটের সদস্য হয়ে থাকে। ...হ্যা... স্যার... স্যার... ওকে। আইল ইনফর্ম ইউ ল্যাটার।'

মোবাইল হাতে নিয়ে কল কেটে দেবার ভান করি। এতক্ষণে ছেলেদু'টির অবস্থা প্রায় কেরোসিন। না পারছে ছাউনি থেকে বের হতে... না বসে থাকতে। ওরা ভাবছে আমি একা, দুজন দুদিকে দৌড় দিলে আমি কাকে ধরবো আগে? কিন্তু ঐ যে ফোর্স আশেপাশে রয়েছে শুনে তাও করতে পারছে না। সাথে রয়েছে গাঁজা। এটা না থাকলে কোন ...ল্টা ফালাইতো তাও হয়তো দেখতো তখন। কিন্তু এখনকার পরিস্থিতি ভিন্ন।

আমি এবার ওদের দুজনের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। ওরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো আমার দিকে তাকায়। আমি হাত পাততেই যার হাতের চেটোতে গাঁজা রয়েছে সে সবটকু দিয়ে দেয়। অন্যজন খালি করা সিগ্রেটের খোসাটিও দিয়ে দিলো। এবার প্রথমজন পকেট থেকে গাঁজার পোটলাটিও বের করে আমার হাতে ধরিয়ে দেয়। সব শেষ হলে আমি বললাম, ' তোমাদের বয়স অল্প বলে আজ ছেড়ে দিলাম। আর কখনো এগুলো ছোঁবে না, বুঝেছ?' ছেলে দুজন ঘাড় কাত করে তাঁদের সম্মতির কথা জানায়। এরপর ওদেরকে বললাম, ' এখন সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে রাস্তার দুদিকে দেখে শুনে রাস্তা পার হবে। তারপর সোজা বাসায়। একবারও পিছনে ফিরে তাকাবে না।'

ছেলে দুটি যেন মুক্তির স্বাদ পেয়ে বাতাসের বেগে ভেগে যেতে চাইলো। কোনোমতে ছাউনি থেকে বেরিয়ে রাস্তার দুদিকে ভালোভাবে দেখে নেয়।এরপর পার হয়ে ফাস্টফুডের দোকানগুলোর পাশ দিয়ে দ্রুত অদৃশ্য হয়ে যায়।

ওরা চলে গেলে স্টিকটি বানালাম।

পকেট থেকে ম্যাচ বের করে ধরাই... আয়েশ করে মিষ্টি গন্ধের কটু ধুঁয়া গিলতে থাকি। যদিও জানি এতে আমার ক্ষুধা আরো বেড়ে যাবে। পকেটে মাত্র দশ টাকার একটি বঙ্গবন্ধুওয়ালা নোট... খেতে হবে তিনবেলা। বিদ্যমান ক্ষুধাকে কিছু সময়ের জন্য ভুলে গিয়ে গাঁজার স্টিকটিতে দম দিতে থাকি ইচ্ছেমত।আমার ফুসফুস ধুঁয়ায় ভরে যায়। চোখ দুটোতে ঝিম ধরে... তবুও সেই ঝিমধরা দৃষ্টির পেছন থেকে অফুরন্ত এক ক্ষুধা উঁকি দিয়ে যায়। আবহমানকাল ধরেই এটা নিজের উপস্থিতি জাহির করে আসছে। একে কেন্দ্র করেই সভ্যতার শুরু... একদিন পতনও হবে একে কেন্দ্র করেই।

একা একা ছাউনিতে বসে বাস-টেম্পুর যাওয়া-আসা দেখছি। তবে কিছুক্ষণের ভিতরেই নেশার হাল্কা আমেজ টের পেলাম। ক্ষুধাটা আরো বেড়ে যাবার আগেই এখন ব্রেইনে অন্য কিছু ঢুকিয়ে দিতে হবে। তাই যে কোনো একটা বিষয় নিয়ে ভাবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে উপলব্ধি করলাম, এমন কোনো বিষয়ই পেলাম না, যা নিয়ে ঠিক এই মুহুর্তে ভাবতে পারি।

ধুর শালা বলে 'ভাববো-ই না কিছু' বলে সংকল্প করলাম। আর সাথে সাথেই একটা ভাবনা মাথায় চলে এলো। ভাবনা না বলে একটা শব্দ মাথায় ঢুকে গেলো।

'গিদার'।

এই শব্দটা বার বার বাজতে লাগলো। বাসের শব্দ থেকে এটি বের হচ্ছে, টেম্পুর হরণের থেকে, আশেপাশের মানুষগুলোও যেন সবাই 'গিদার... গিদার... ' করছে। আমি বুঝতে পারলাম স্পষ্ট এগুলো হ্যালুসিনেশন ছাড়া আর কিছুই নয়। গাঁজার প্রভাবে মস্তিষ্ক উদ্দীপ্ত হওয়াতে এমনই হচ্ছে। আর একটু আগে দুজন যাদেরকে সমুসা খেতে দেখেছিলাম, তারাই এই শব্দটার সাথে লিঙ্ক হয়ে গেছে।

কি আর করা!

এখন এভাবেই থাকতে হবে.. ভাবতে হবে।

আচ্ছা গিদার নিয়ে যদি কোনো রচনা লিখতে বলত, কি লিখতাম?

" গিদার একটি বিদেশী শব্দ। ইহা আমাদের বাংলা শব্দভান্ডারকে ধার করা সংস্কৃতির অনুভূতি দ্বারা ভীষণভাবে আলোড়িত করিয়াছে..."

হঠাৎ ভাবলাম, সাধু ভাষায় কেন লিখছি?

তাইতো, একটু কি বেশী 'হইয়া গেলো' নাকি?

এবার নিজেকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করলাম। স্বাভাবিকভাবে গিদার নিয়ে মনে মনে ভাবতে শুরু করলাম। যারা খুব নোংরা জীবনযাপন করে এদেরকেই গিদার বলা হয়। গিদারদের ভিতরে ধনী-গরীব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত এবং মহিলা-পুরুষ রয়েছে।

সচরাচর যে শ্রেণীর গিদারদেরকে আমরা দেখতে পাই, তারা সাধারণত সকালবেলাতেই পরিলক্ষিত হয়। টুথ-ব্রাশে পেষ্ট লাগিয়ে জনসম্মুখে ঠোঁটের দু'পাশে ফেলায় ভরিয়ে এরা চলাচল করে। আর কিছুক্ষণ পরপর চলার পথে নিজেদের 'গিদারামির' নিদর্শণ রেখে যায় থুথু ফেলার দ্বারা।

এরপরের শ্রেনী হল, নিজেদের শরীরের স্পর্শকাতর যায়গাগুলো ইচ্ছেমত অন্যের সামনে চুলকায় এবং নিজের অজান্তেই যে হাত দিয়ে চুলকায়, সেটি নাকের কাছে নিয়ে গন্ধ শোঁকে। এরা খুবই খারাপ ধরণের বিকৃত গিদার।

এদেরকেও অতিক্রম করে গেছে আরো একধরণের গিদার। তারা নিজেদের শরীরের বিভিন্ন যায়গা খুঁটে খুঁটে ময়লা খেয়ে থাকে। যেমন নাকের অথবা কানের ময়লা। অনেকে আবার দাঁতের ফাঁকা থেকে ময়লা বের করে...

একশ্রেণীর গিদার সবার সাথে খেতে বসে নিজেদের নামের পরিচয় দিয়ে থাকে। এরা খাবার সময় ব্যস্ততা হেতু (হয়তো এদের ট্রেন ছুটে যাবে, তাই খুবই ব্যস্ত এরা) দ্রুত খাবার সাবাড় করতে গিয়ে, মুখের থেকে খাদ্যকণা আশাপাশের মানুষের শরীরে ফেলে দেয়। কিংবা অন্যের প্লেটে গিয়ে পড়ে। এরা খুবই শব্দ করে খাবার খায়, যা অন্যের শ্রবণযন্ত্রকে বিড়ম্বনার ভিতরে ফেলে দেয়। এরা খাবার খাওয়া শেষ হলে প্রচন্ড শব্দে ঢেঁকুর তোলে এবং এক নিঃশ্বাসে ঢক ঢক করে পানি পান করে। এদের খাবার খাওয়া দেখলে প্যাকে ঘোরাফেরারত হাঁসের কথা কেন জানি মনে হয়।

আর এক শ্রেনীর গিদার রয়েছে, রাস্তাঘাটে যেখানে সেখানে প্যান্টের জিপার খুলে দাঁড়িয়ে যায়। এদের ভিতর কেউ কেউ বসেও পড়ে। তবে সেভাবে বেশীক্ষণ থাকতে পারে না প্রচন্ড টাইট প্যান্ট পড়ার কারণে। একটু বসেই এরা উঠে পড়ে। বলাইবাহুল্য এই শ্রেনীর গিদারেরা সবাইই পুরুষ শ্রেনীভুক্ত।

(আমি নিজেও এই শ্রেনীর, তবে অনিয়মিত গিদার। একেবারে অতিরিক্ত প্রয়োজন না পড়লে, আমার ভিতরের এই গিদারামি প্রকট হয়না)

একধরণের গিদার বাহিরে ফিটফাট, ভিতরে সদরঘাট টাইপের। এদেরকে তাদের বাসায় তাদের একান্ত নিজেদের সময়ে গেলে দেখা যায়। এরা এদের ভিতরে পড়বার স্যান্ডো গেঞ্জিটি মনে হয় বছরের পর বছর পরে থাকে। পড়তে পড়তে একেবারে রঙ হলুদ হয়ে যায়, এবং এটি যে কোনোকালে সাদা ছিল- তা যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার বিষয়বস্তু হতে পারে। আর একই কথা এদের অন্তর্বাসের ক্ষেত্রেও বলা যায়। এদের ভিতর যদিও পুরুষদের সংখ্যা বেশী, তবে কিছু কিছু মহিলা গিদারও পরিলক্ষিত হতে পারে (আমি নিজে যেহেতু দেখি নাই, তাই এ ব্যাপারে শিওর না)।

আর এক ধরণের গিদার রয়েছে, এরা নিজেদের সিঁড়ির দরোজার সামনে পলিথিনের ভিতরে কয়েকদিনের রান্নাঘরের জমানো ময়লা যার ভিতরে মাছের আঁশটে, ডিমের খোসা (এমনকি ব্যবহৃত কন্ডমও থাকে) সব্জির কাঁটা অংশবিশেষ ইত্যকার বাসি-পচা জিনিস ভরে রেখে দেয়। এই শ্রেনীর ভিতরে দু'টি সাব-শ্রেনী রয়েছে। একদল নিজেদের তলা বাদ দিয়ে অন্যের সিঁড়ির দরোজার সামনে রেখে আসে; অন্যদল এতো ঝামেলার ভিতরেই যেতে চায়না। এরা বেশ নিরীহ টাইপের। নিজেদের ব্যালকনির গ্রীল অথবা বাসার পিছন সাইডের জানালা দিয়ে এই ময়লাগুলোর সদ্ব্যবহার করে থাকে।

একটা বাস বেশ শব্দ করেই আমার ছাউনিটির সামনে এসে দাঁড়ালো। আমার ধ্যান ভেঙ্গে যায়। একটু বিরক্ত হলাম। সুন্দর একটি বিষয়ের অনেক গভীরে চলে গেছিলাম। হতচ্ছারা ড্রাইভার এভাবে জোরে হর্ণ না দিলে কি চলত না? বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ড্রাইভারের নির্লীপ্ত চেহারার দিকে একবার তাকালাম। সে কোনো গুরুত্বই দিলোনা আমার তাকানোকে।

এমনই হয়।

যার পেটে অফুরন্ত ক্ষুধা, পকেটের অবস্থা গড়ে মাঠ- তাদেরকে কিভাবে যেন সবাই প্রথম দর্শনেই চিনে যায়। বুঝে যায় যে এদেরকে নিয়ে ভাববারই প্রয়োজন নেই।

আমিও তাদেরই দলের একজন।

একজন অপাংক্তেয়... একজন অতিসাধারণ মানুষ, যার পকেটে মাত্র দশটি টাকা রয়েছে... যে একজন 'মেকুর' হবার সাধনায় নেমেছে...

এবং ঠিক এই মুহুর্তে যার পেটে প্রচণ্ড ক্ষুধা... ধুত্তুরি.. আবারো সেই ক্ষুধাকে অনুভব করে ফেললাম।

নিজের নাকউঁচু ভাবটির গলা টিপে ধরে বঙ্গবন্ধু হলের দিকে পায়ে হেঁটে রওয়ানা হলাম। ইন ছাড়া প্যান্ট-শার্টের সাথে একটি ফিতেওয়ালা স্পঞ্জের স্যান্ডেল পায়ে একজন মেকুর আবারো পথে নেমেছে। Rose Good Luck

(ক্রমশঃ)

বিষয়: সাহিত্য

১০০৭ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

269598
২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সন্ধ্যা ০৭:০৯
কাজী লোকমান হোসেন লিখেছেন : গিদার হয়ে গেলুম Cheer Cheer Cheer Cheer ভালো লাগলো গল্পের মাঝে একদম আছোলা বাঁশ Cheer Cheer Cheer Cheer ধন্যবাদ Rose Rose Rose Rose Rose Rose Rose Rose Rose Rose Rose Rose Rose Rose Rose Rose Rose Rose Rose Rose Rose Rose Rose Rose Rose Rose Rose
২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সকাল ০৭:৫১
213686
মামুন লিখেছেন : ধন্যবাদ ভাই।
আপনার অনুভূতির জন্য আপনাকে ধন্যবাদ এবং শুভেচ্ছা।
জাজাকাল্লাহু খাইর।Happy Good Luck Good Luck
269621
২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪ রাত ০৮:০১
ফেরারী মন লিখেছেন : বরাবরের মতই ভালো লাগলো। নতুন করে বলার কিছু নাই নাই গো নতুন করে বলার কিছু নাই।
২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সকাল ০৭:৫২
213687
মামুন লিখেছেন : ধন্যবাদ।
অনুভূতি রেখে যাবার জন্য আপনার জন্য অনেকগুলো লাল গোলাপের শুভেচ্ছা রইলো।Good Luck Good Luck
269705
২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ রাত ০৩:৩৯
মাহবুবা সুলতানা লায়লা লিখেছেন : বরাবরের মতই ভালো লাগলো চলুক.....সাথেই আছি!
২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সকাল ০৭:৫২
213688
মামুন লিখেছেন : অনুভূতি রেখে যাবার জন্য অনেক ধন্যবাদ এবং শুভেচ্ছা।
জাজাকাল্লাহু খাইর।Happy Good Luck
270073
৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৪ রাত ০১:৪০
আবু সাইফ লিখেছেন : আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ..



"গিদার" গবেষণা ভালই হয়েছে Thumbs Up


জাযাকাল্লাহ
৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সকাল ০৮:০৩
214074
মামুন লিখেছেন : ওয়ালাইকুম আসসালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু।
ধন্যবাদ।
অনুভূতি রেখে যাবার জন্য শুভেচ্ছা রইলো।
জাজাকাল্লাহু খাইর।Happy Good Luck

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File